Book Review - চৌরঙ্গী

জীবনের খেলাঘরে খেলতে খেলতে পরিচয় হয় কতো শত মানুষের সাথে। অন্তরের অন্ত:স্থলে জায়গা কেড়ে নেয় কেবলই কয়েকজন। আর সেই কয়েকজনকেই বা আমরা ভালোমতো চিনি কিংবা জানি? জীবনের নির্মম নিষ্পেষনের দহনে পুুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাওয়া প্রতিটা মানুষের হৃদয়ের কালি মাখা চাদরের আড়ালের জীবন সম্পর্কে ক'জন ই বা জানি?

মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের সেরা রচনা "চৌরঙ্গী" আমাকে জীবনের মানে খোঁজার নতুন এক চৌরাস্তায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। "চৌরঙ্গী" কেবল একটি উপন্যাস নয়। উত্তম পুরুষে বর্ননাকৃত এই উপন্যাসের নায়ক কেবল একজন নয়। এই বইয়ের প্রতিটা চরিত্র তার নিজ নিজ জীবনের নায়ক। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজেদের জীবনের নায়ক। আমরাই জানি আমরা কি করছি, আমরাই জানি আমাদের জীবনের কাহিনী। আমরাই কেবল জানি জীবনের এই প্রান্তে এসে দাঁড়াতে কতোটা বিসর্জন করে এসে দাঁড়াতে হয়েছে। গল্পে যখনই একটুখানি সুখের আভাস কোথাও পেয়েছি, এক অজানা ঘূর্ণিঝড় যেন সাথে সাথে ধুলিস্যাত করে দিয়েছে সমস্ত আশা-ভরসা। আমাদের জীবনটা তো আসলে এমনি তাইনা। অনন্ত সুখ নিয়ে তো জীবন নয়, কেবল কষ্ট নিয়েই জীবন। তার মাঝেই মানুষ চেষ্টা করে সুখ খুঁজে পাওয়ার। জীবনের সবকিছু মুহুর্তের নোটিশে হারিয়েও মানুষ দাঁড়িয়ে যায় নতুন করে আশা বেঁধে, নতুন করে সুখের সন্ধানে। আর কেউ কেউ কষ্ট পেতে পেতে আর কষ্টের ফাঁদে পা না দেওয়ার উদ্দেশ্যে চেনা-পরিচিত পরিবেশ থেকে পাড়ি দেয় অজানা গন্তব্যে।

আহারে সুখ, আহারে মরিচিকা। মাঝে ফেসবুকে ট্রেন্ড উঠেছিলো, "কি হবে এতোকিছু করে, একদিন তো মরেই যাবো।" কষ্ট কাউকে কখনোই পিছু ছাড়বেনা, মরণের আগ পর্যন্ত না। তবে কি কেবল মরণেই প্রকৃত সুখ ? মুহূর্তের মধ্যে সকল সমস্যার সমাধান ?

বেদুঈনদের শেকড়হীন জীবনটা তাই আমাকে ইদানীং টানে খুব করে। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে, কোন বাঁধন ছাড়া ধু ধু বালুর বুকে নিরন্তর পথচলা। কোন দুশ্চিন্তা নেই। মডার্নিটির কালো ছায়া ছুঁতে পারবেনা যেখানে কোনভাবেই। নিস্তরঙ্গ বালুর ঢেউয়ের মাঝে জীবনের জিজ্ঞাসা খুঁজে চলার নির্মম পথে হতাশা আর একঘেয়েমি থেকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বাঙ্গালি পুরুষের নীরব, ভালোমানুষি, নিস্তরঙ্গ, পুরুষহীন জীবন নিয়ে বিরক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদার ও লিখে গিয়েছেনঃ

ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুয়িন!
চরণতলে বিশাল মরু
দিগন্তে বিলীন।
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি,
জীবনস্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি
চলেছি নিশিদিন।
বর্শা হাতে, ভর্‌সা প্রাণে,
সদাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন বহে
সকল বাধাহীন।

কেনো এতো চাহিদা তবে, কেনো এতো চাই চাই ? কেনো এতো হতাশা, অপূর্ণতা, অসন্তুষ্টটা। Materialism এর মোহে ডুবে গিয়ে অনন্ত অসীম চাহিদার যোগানের ব্যবস্থা করতে করতে জীবনকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছি প্রতিদিন। জানিনা আমাদের চাহিদার সমাপ্তি কোথায়, আমাদের সুখ কোথায়। নতুন একটা মোবাইলে ? নতুন একটা কম্পিউটারে? সুখ তবে কি কেবল নতুন নতুন কোন জড়বস্তুতে ? বস্তুবাদ কি তবে হারিয়ে দিলো সুখের সংজ্ঞা আমাদের কাছে ? সুখ কি কেবল একটা সুন্দর চাকরীতে? সুখ কেবল ৯-৫টা অফিসে? যত আমরা বস্তুবাদে নিজেদের সুখ খুঁজার চেষ্টা করবো ততো বেশী দিশেহারা হয়ে যাবো। মডার্নিটির চোরাবালিতে আরো বেশী নিমজ্জিত হবো।

একবুক হাহাকার নিয়ে শেষ করেছি বইটি। দুনিয়ার প্রতি এক রাশ বিরক্তি এর রাগ নিয়ে সমাপ্তি টেনেছি বইটির। সংকর চেষ্টা করেছেন শেষে কিছু আশার বানী শোনাতে, কিন্ত আমার কাছে Rudyard Kipling এর যেই লাইন কয়টি দিয়ে দুনিয়ার সর্বনাশের দুয়া করেছেন তাতেই উপন্যাসের ইতি

All good Calcutta has gone to bed, the last tram has passed, and the peace of the night is upon the world. Would it be wise and rational to climb the spire of that Kirk, and shout: ‘O true believers! Decency is a fraud and a sham. There is nothing clean or pure or wholesome under the Stars, and we are all going to perdition together. Amen!’