গোর্কি
রোজ রোজ সেই এক। সেই ভোর না হতেই অ্যালার্ম বেলের বিশ্রী চিৎকার। ঢাকা শহরের ধোঁয়াটে তেলচিতে আকাশটা আঁতকে ওঠে। ও তো ডাক নয়, যেন সমন। পেশীগুলো চাঙা হয়ে উঠার আগেই গুমোট ঝাপসা অন্ধকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধড়ফড় করে উঠে খুপড়িগুলো থেকে অন্ধকার মুখে মানুষগুলো বেরিয়ে আসে ভয়-খাওয়া আরশোলার মতো। লোকাল বাসে জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে, ঠেলাঠেলি করে রওনা হয় গন্তব্যের পথে। অফিস-কলকারখানার সার-বাঁধা খুপরিগুলো ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার আত্মপ্রত্যয়ে। সারাদিন ধরে চলে জান্তব মানুষগুলোর অর্থের পিছে ছুটে চলার উন্মত্ততা। যন্ত্র-গাড়িগুলোর প্যাঁ-পো আর মানুষের খিস্তির তোড়ে বাতাস বিদীর্ণ হয়।
তারপর যখন সন্ধে হয়, পড়ন্ত সূর্যের ক্লান্ত ছায়া এলিয়ে পড়ে জানালায় জানালায় পোড়া-কয়লার চাইয়ের মতো করে কারখানাটা তাঁর পাথুরে ভুঁড়ি থেকে মানুষগুলোকে উগরে ফেলে। আবার সেই নোংরা রাস্তা বেয়ে কালিঝুলি মাখা কালো কঠোর মুখের মিছিল; ক্ষুধার্ত ঠোটের ফাকে দাঁতগুলো ঝিলিক দেয়। ধুলো-ময়লা আর ঘামের গন্ধ বেরোয় চটচটে গা দিয়ে। কিন্তু এ বেলা গলার স্বরে ফুরতির এমনকি আনন্দের সুর- আজকের মতো খাটুনি সারা। এখন ঘরে ফিরে কিছু গিলে শরীরটা এলিয়ে দেওয়া।
ওদের দিনগুলোকে গিলে খায় অফিস আর দেহের শক্তি নিংড়ে নিংড়ে যতটা পারে শুষে নেয় অফিসের কাজ আর মনগুলোকে পঙ্গু করে দেয় জ্ঞানের দৈন্যতা। একটা একটা করে দিন এমনি করে যায় – একেবারে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, আর এক এক করে কবরের দিকে এগিয়ে যায় মানুষগুলো। কিন্তু তা হোক, এখনকার মতো তো দেহটা বিশ্রাম পাবে।
শুক্রবার দিন ঘুম ভাংতে সকাল দশটা। বাইরে গিয়ে পত্রিকায় গিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে, গোসল-গা ধুয়ে একটা দিন স্রষ্টাকে মনে করার চেষ্টা করে। আর ছেলে-ছোকড়াদের গাল পাড়তে থাকে মসজিদটাকে মাছের বাজার বানিয়ে ফেলায়। নামাযের পর বাড়ি ফিরে খেয়ে-দেয়ে আবার লম্বা ঘুম সেই সন্ধ্যা অবধি।
কারো সঙ্গে দেখা হলে সেই একই কথা- অফিস, রাজনীতি আর সংসার। “রাজনীতি দেশটাকে খাইল” বলে চিৎকার করতে থাকা মানুষগুলোর মূল্য বাড়ে শুধুমাত্র নির্বাচনের সময়ে। বাকি দিন-মাস-বছর গুলোতে মানসিক দৈন্যতায় আটকে থাকা মানুষগুলো শুধু গালি দিয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটুকু ওদের বেলায় কি যেন এক বিদ্বেষ বিষিয়ে থাকে; যে কোনো মুহূর্তে ফেটে বেড়িয়ে পড়ে। কখনোবা বাসের কন্ডাক্টারের সাথে দুই টাকার জন্যে মারামারি বেধে যায়,কখনোবা সম্পত্তির জন্য নিজের আপন ভাইয়ের গলায় ছুরি চালায়। ও বিষ ঝেড়ে ফেলা যায়না; তা দেহের অনপনেয় ক্লান্তির মতোই। বাপ থেকে বেটায় সংক্রমিত হয় সে বিষ, কালো ছায়ার মতো একেবারে কবর পর্যন্ত অনুসরন করে। ওই বিষের জ্বালায়ই ওরা অযথা ক্রুর জঘন্য সব অপরাধ করে থাকে।
মাঝে মাঝে কিছু মানুষ আসে। নিয়মিত আল্লাহকে ডাকতে বলে, নামায পড়তে বলে। ইসলাম নিয়ে ভাবতে বলে, পড়ালেখা করতে বলে। তারা শুনে প্রত্যেকেই, কেউ তর্ক করেনা। কেউ চটেও যায়, কারুর মনে আবার কিসের জানি শঙ্কা জাগে। কি যেন একটা আশার আবছা ছায়াও দোলা দিয়ে যায় কারুর মনে।
দশের থেকে কেউ আলাদা হলেই ওরা সন্দেহের দিকে তাকায়। মৌলবাদী নাতো আবার!!! সেই সন্দেহের কারণ তাদের অজানা। যেন ভয় পায় – হোক পানসে জোলো, এইতো গান-টান শুনছি, মেয়ে কলিগদের সাথে আড্ডাবাজি করছি, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি মাঝে মাঝে একে অন্যের গায়ে, ছেড়া-ফাটা রাস্তা ধোয়া জিন্স পড়ে রাস্তায় হাটছি, ঘুষ-সুদ খাচ্ছি, মোটের উপর একটা ধারায় চলছে তো জীবনটা। কে জানে কি ঝামেলা বাধাবে ওই সব লোকগুলো। স্কূল জীবন থেকে দেখে আসছে তাদের, অফিসগুলোতে এসেও তারা তাড়া করে ফেরে। নাই বা থাক সুখ, স্বস্তি তো আছে। জীবনের ভারি বোঝাটা একই ভাবে বয়ে এনেছে ওরা। বইছে বইবে। জেনে রেখেছে ও থেকে মুক্তি নেই। আর মুক্তিই যদি নেই, তবে হেরফের হলে দুঃখ বাড়বে বই, কমবেনা।
অতএব যারা নতুন কথা বলে, কর্ম জীবনে তাঁদেরকে তারা চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যায়। বছর ৫০ এর পড়ে তাদের মনে পড়ে স্রষ্টার কথা, আখিরাতের কথা, ৫০ বছরের পাপ একবারে মুছে ফেলার জন্য তারা ততপর হয়ে উঠে। এমনি করে গোতা ৬০ বছর কোনমতে বেচে থেকে লোকগুলো একে একে মরে যায়।
ম্যাক্সিম গোর্কির “মা” উপন্যাসের প্রথম অংশ থেকে, সংকলিত এবং সম্পাদিত।