তুরষ্কে মসজিদ প্রোগ্রাম
এলাকায় ছোট একখান মসজিদ আছে। সেইটার ভিতরের জায়গা আবার স্পেশাল, এসিওয়ালা। মানুষজন এসির ভিতরে যাইয়া বসার লাইগা কাড়াকাড়ি লাগায়। গায়ের উপরে পা তুইলা দিয়া নিনজার মতো এসিওয়ালা ঐ খুপড়িরভিতরে ঢুকে। কাঁচের স্লাইডিং দরজার গায়ে বড় করে লেখা, "বাচ্চাদের পেছনে রাখুন"।
অন্য মসজিদগুলোতেও একই অবস্থা বাচ্চারা সামান্য আওয়াজ করলে, ছুটোছুটি করলে বয়সে বড় মানুষজন হাকডাক শুরু করে। ওদের থামাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। চিৎকার-চেচামেচি করে তাদেরকে ছাদের উপরে পাঠিয়ে দেয়। তাদেরকে পেছনের দিকে পািয়ে দিয়ে নিজেরা কিভাবে সামনের দিকে বসা যায় সেই ব্যাপারে খুব তোড়জোড় তাদের।
যাই হোক, এগুলা তো দেশে ২৫ বছর দেখলাম। তুরষ্কের বর্তমান অবস্থার সাথে একটু তুলনা করি। ২০ বছর আগের তুরষ্ক না, বর্তমান তুরষ্ক। ইজমির-আন্কারা নয় কোনিয়া শহরের কথা বলছি।
তার আগে একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই। তুরষ্ক নিয়ে অনেকের মনে বিতৃষ্ণা, অনেকের মনে চরম ফ্যাসিনেশন। তুরষ্ক অনেক বড় একটা দেশ। এতো বিরাট একটা অংশের সব জায়গায় সব বাতাস সমানভাবে লাগেনা। ইউরোপের বাতাস ইজমির, ইস্তানবুল, আঙ্কারায় যেভাবে লাগে, কোনিয়া কিংবা পূর্বান্চলের এলাকায় সেভাবে লাগেনি। আর আতাতুর্কের সেকুলারাইজড রিফর্ম দেশের সব মানুষ এসেপ্ট করতে পারে নাই। দেশের ধার্মিক জনগোষ্ঠী তখন ও ছিলো, কিন্ত তাদের বলার স্পেস ছিলো না, এরদোয়ান আসার পরে তাদরেকে সেই স্পেস উনি তৈরি করে দিসেন আস্তে আস্তে। বর্তমান অবস্থা হলো, "কষ্টকাঠিন্য"। নিউ জেনারেশন একটা দু'মুখি আইডিওলওজির চাপে পিষ্ঠমান। একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে তারা।
মূল টপিকে আসি। এইযে ক্রাইসিসের ভেতরে দিয়ে যাওয়া একটা প্রজন্ম, এদেরকে কিভাবে লাইনে আনা যায় ? তারই প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিটা মসজিদ ই অনেক বড় এলাকা নিয়ে বানানো হয়। প্রায় প্রতিটি মসজিদেই মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা আছে। বেশ আলাদা বড় একটা এরিয়া নিয়ে মহিলাদের নামাজের ঘরের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক মসজিদে বাচ্চাদের জন্যে বাইরে খেলার ব্যবস্থা রাখা হয়। স্লাইডার, ঘুর্ণি আরো হাবিজাবি।
খুব রিসেন্ট যেটা দেখলাম সেটার কথা বলতে চাই। রমজান মাসেই কোনিয়া সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে ৭-১৪ বছরের বাচ্চাদের জন্যে একটা প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগীতার শর্ত হলো, ১৯শে জুন থেকে ১৩ই আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২ মাস সময়ে ৪০ দিন যেসব বাচ্চারা ফজরের নামাজের জন্যে মসজিদে আসবে, তাদের সবাইকে সাইকেল উপহার দেওয়া হবে। তুরষ্কের প্রতিটা মসজিদই সরকারের অধীনে হওয়ায়, পুরো শহরের সব মসজিদের বাচ্চাদের ট্র্যাক করা এবং হিসাব রাখা সহজ হয়েছে। এই ইভেন্টটার প্রচারের জন্যে ১মাস আগে থেকেই প্রতিটি মসজিদে জুমার নামাজের সময়ে ইমাম সাহেব এটার ব্যাপারে আলাপ করতেন। মসজিদে মসজিদে এই প্রোজেক্টের ব্যনার-ফেস্টুন টানানো হয়। বাচ্চাদের উৎসাহিত করতে তাদের পছন্দ হবে এমনভাবে কালারফুল পোস্টার ছাপানো হয়। নতুন নতুন স্লোগান ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের স্লোগান ছিলো এমন,
Camide çocuk sesi,
Vatanımın neşesi
এর মানে, মসজিদে বাচ্চাদের স্বর শুনতে পাওয়া হচ্ছে মিল্লাতের আনন্দ। ওরা বাচ্চাদের আওয়াজ শুনতে পাওয়া জন্যে ব্যানার ছাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর আমরা তো ভাই এখনো আলহামদুলিল্লাহ ভাগ্যবান যে বাচ্চাদের আওয়াজ শুনতে পাই, সেটাও এখন বন্ধ করে দেওয়ার তালে আছি।
গত ২৬শে আগস্ট এই প্রোজেক্টের সমাপ্তি টানা হয়, এবং বিজয়ী বাচ্চাদের পুরষ্কৃত করা হয়। এবং অবশ্যই অনুষ্ঠানটি হয় ফজরের নামাজের পরে। হাজার হাজার মানুষ সেলিমিয়ে মসজিদের সামনে একত্র হয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। অনুষ্ঠানটির কিছু ছবির লিঙ্ক কমেন্ট সেকশনে দিচ্ছি।
শুধু এই সকল কার্যকলাপেই যে তুরষ্ক ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যাবে সেটা বলছিনা। সেটা আশাও করছিনা। জাস্ট কোথায় কাদের সাথে কিরুপ আচরণ করা হয়, সেটার পার্থক্য বলছি। রাষ্টের দায়িত্ব ভবিষ্যতে এই নতুন প্রজন্মই নিবে, তাইনা ? তাদেরকে কোন দিকে গাইড করতে চাই তার দায়িত্ব আমাদের সবার।
